আপনি প্রেমের পথে যাত্রা করবেন। হৃদয়ের দিকে দৃষ্টি দিন। আসেন, ইচ্ছা পবিত্র করি। পবিত্রতাকে আহরণ করি ঈমান থেকে। ঈমান আমাদের নিয়ে যাবে ইতিবাচক বা সৎ জীবন-যাপন, নিশ্চিন্ততা ও অন্তরের প্রশান্তির দিকে। ইচ্ছা বিশুদ্ধতা অর্জনের প্রাথমিক পর্যায়ে যখন আছেন, আপনি হলেন মুরিদ বা ইচ্ছাকারী, সুফিরা মুরিদকে বলেন শিষ্য। আপনার এবার চাই একাগ্রতা ও দৃঢ়তা। যা আত্মদমনে আপনাকে অনুপ্রাণিত করবে। এই যে আপনার পাপপ্রবণ নফস, তাকে নিজের প্রশান্ত নফসের অনুগত করার দীর্ঘ পথে আপনি এখন অভিযাত্রী। এই যাত্রাপথে লক্ষ্যপূর্ণ করতে হলে তিনটি আধ্যাত্মিক এলাকা পাড়ি দিতে হবে। অর্জন করতে হবে তিন স্তর। সেগুলো হচ্ছে-
১. তাখলিয়াহ : অর্থ ‘খালি করা’; পারিভাষিক অর্থে শরীরকে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করার জন্য নিজেকে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ও ঝোঁকপ্রবণতা থেকে মুক্ত করা।
২. তাহলিয়াহ : অর্থ ‘অলঙ্কার দ্বারা সুসজ্জিতকরণ’; পারিভাষিক অর্থ ব্যক্তির আত্মাকে উন্নত নৈতিক গুণাবলি দ্বারা ভূষিতকরণ।
৩. তাজলিয়াহ : অর্থ ‘আলোকোদ্ভাসিত হওয়া’; পারিভাষিক অর্থ ঐশী সত্তায় নিমজ্জিত হওয়া অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা এক এবং অদ্বিতীয় এবং তিনি ভিন্ন আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই- এ সত্যের যথার্থ স্বীকারোক্তির লক্ষ্যে স্বীয় আমিত্বকে পরিত্যাগ করা। আমিত্বকে পরিহার করবার মধ্য দিয়ে আপনি খোদাপ্রেমের বিশেষ সীমানায় প্রবেশ করলেন। আপনি প্রেমের হাত ধরেছেন। সে আপনাকে কত সাগর, মরুভূমি পার হওয়ার দিশা দেবে। সাতটি উপত্যকা পাড়ি দিতে হবে প্রেমের পথে। কোনোটাই সহজ নয় আদৌ। সেগুলোর দিকে তাকান-
১. আকাঙ্ক্ষা ও সন্ধান : প্রেমিকের মধ্যে জ্বলন্ত থাকবে না পাওয়ার বেদনা ও প্রতীক্ষার অনুভূতি। তার অন্তর হবে ব্যাকুল, উদগ্রীব, অদৃশ্যজগতের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষী। সে সর্বত্র প্রিয়তমের সন্ধান করে। সন্ধানের এই পর্বে হৃদয়কে দক্ষ করা চাই।
২. প্রেম : প্রেমিকের উদগ্রীব প্রতীক্ষা ও ঐকান্তিকতা হৃদয়ে তৈরি করছে জ্বালা ও জ্বলন। সুমিষ্ট অনুভূতি মধুময় করছে চিত্তকে। বিরহের বেদনা দগ্ধ করছে হৃদয়কে। প্রিয়তমের সঙ্গে মিলনের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় ও বিচ্ছেদের আগুনের মাঝখানে প্রেমিক আবর্তিত। প্রিয়তমের সন্ধানে কোন চেষ্টা থেকেই প্রেমিক বিরত থাকবেন না। তার চেষ্টাগুলোকে পথ দেখাচ্ছে শরিয়ত।
৩. ইরফান : শরিয়ত অনুযায়ী আমলে আছেন প্রেমিক, তরিকতের পথ পাড়ি দিচ্ছেন। অন্তরে আসমানি জ্ঞানের নুর বা আলো চমকাবে। এই নুর নিয়ে আসবে সত্য উপলব্ধি। তা বাড়বে, বাড়তে থাকবে। আবার জোয়ার-ভাটাও চলতে থাকবে। প্রেমিক উপলব্ধি করবেন মহাবিশ্বে আল্লাহতায়ালা ছাড়া অন্য কোনো শক্তির অস্তিত্ব নেই। আত্ম উপলব্ধির বিকাশ ও স্বচ্ছতা উদযাপন করবেন। আল্লাহকে উপলব্ধি করার স্তরে উপনীত হবেন এবং সর্বত্র খোদায়ী নিদর্শন দেখবেন।
৪. মুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্তি : এবার প্রেমিক শুধুই আল্লাহর দিকে, শুধুই তার সমীপে। আল্লাহ ছাড়া সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। হৃদয় শুধুই তার দিকে থাকবে। আর কোথাও নয়, আর কোথাও নয়।
৫. তাওহিদ : প্রেমিক এবার অনুভব করবেন মর্মরহস্য। তার হৃদয়ে পরম প্রভুর তাওহিদ যেন সুস্থির, বাকমুখর। রহস্যের মর্মবাণী ও তাওহিদের শিখা নিজের হৃদয়ে জ্বলতে দেখবেন তিনি।
৬. দিশাহারা অবস্থা : প্রেমিক এবার সর্বশক্তিমান ও মহামহিম আল্লাহতায়ালার সীমা-পরিসীমাহীন মহিমার সামনে দিশাহারা ও হতবুদ্ধি অবস্থায় নিমজ্জিত। অনবরত এক বিস্ময় থেকে আরেক বিস্ময়ে হারিয়ে যেতে থাকবেন। এক তরঙ্গ থেকে আবর্তিত হবেন আরও অধিক তরঙ্গে।
৭. দারিদ্র্য ও আত্মবিনয় : প্রেমিকের বোধে এবার কোনো বহুত্ব নেই। জগতের কোথাও নেই। কারণ সব কিছুই একত্বের শৃঙ্খলা। বহুত্ব একত্বের মাঝে বিলুপ্ত। নানা চরিত্রের ঢেউ, কিন্তু তারা সমুদ্রের সত্তায় বিলুপ্ত। প্রেমিক নিজেও বিলুপ্ত। কখনও নিজেকে হারান, কখনও ফিরে পান। প্রেমের দশায় তিনি এতোই প্রগাঢ়, প্রখর, প্রবল ও প্রদীপ্ত, যার মাত্রাগুলোকে জাহির করার জন্য ভাষা অক্ষম হয়ে গেছে। খোদার প্রেমের শরাব পিয়ে প্রেমিক বেহুশ বটে, কিন্তু এই বেহুশির ভেতরে দুনিয়ার সকল হুঁশিয়ারের হুঁশকে অতিক্রম করে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে, অনেক ঊর্ধেŸ।
আল্লাহর প্রতি ঈমানের ফল হলো আল্লাহর প্রেম- এ হাকিকত স্বীকার করার পর প্রশ্ন জাগে যে, বান্দার জন্য আল্লাহর ভালোবাসার বাস্তবপন্থা কী? মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এর জবাব প্রস্তাব করেন, ‘আল্লাহর ভালোবাসার পথ তাঁর বান্দাদের ভালোবাসার এলাকা দিয়ে এগিয়ে যায়। যে ব্যক্তি খোদার ভালোবাসা চায়, তাকে অবশ্যই খোদার বান্দাদের ভালোবাসতে শিখতে হবে। আল্লাহর ভালোবাসায় তার সৃষ্টির জন্য সম্পদ ব্যয় করবে।’ (তরজমানুল কোরআন, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ১৮)। কোরআন বলছে, তারা আল্লাহর ভালোবাসায় মিসকনি, এতিম এবং বন্দিদের খাদ্য দান করে।’ (সুরা ইনসান : ৮)। তাদের মন বলে যে, ‘আমরা তো তোমাদের খাওয়াই শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আমরা তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা ইনসান : ৯) বিভিন্ন হাদিসে খোদাপ্রেমের ব্যবহারিক পন্থার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। (মুসলিম : ২৫৬৯)। সুফিরা খোদায়ি ভালোবাসার এই ব্যবহারিক পন্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। মানুষের সেবায় নিবেদিত ছিল তাদের জীবন। মানুষের হৃদয়কে প্রেমের সম্পর্কসূত্রে গ্রথিত করতে তারা উদগ্রীব থাকতেন। কাউকে কষ্টে দেখলে মন খারাপ হয়ে যেত। ক্ষুধার্তের কথা মনে হলে গলার আহার আটকে যেত। মানুষের সেবাকে এই বুজুর্গরা তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বানিয়ে নেন। শায়খ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রহ.) বলতেন, কেয়ামতের বাজারে সবচেয়ে বেশি দামি পণ্যের নাম হলো মানুষের অন্তরকে শান্তনা দান।’ (সিয়ারুল আওলিয়া : ১২৮)।
মহান সুফিরা প্রথম প্রকারের আনুগত্যে যেমন ছিলেন মগ্ন, তেমনি তার সমগ্র জীবনকাল ছিল দ্বিতীয় ধরনের আনুগত্যের মোহনা। তারা নিজেকে ছাড়া বাকি সকলের জন্য ভাবতেন। মানে তাদের সকল সাধনা ছিল সারা জাহানের মাখলুকের জন্য। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন এ পথে। এমনকি আখেরাতের প্রাপ্তির প্রশ্নেও তারা ছিলেন আল্লাহর সৃষ্টির জন্য আত্মবিসর্জিত। নিজের জান্নাত-জাহান্নাম তার বড় চিন্তা ছিল না, বড় চিন্তা ছিল পুরো জগতের সব মুকাল্লাফের (মানুষ-জীনের) জান্নাত-জাহান্নাম। দুনিয়ার জীবনে তারা প্রত্যকের পেরেশানি ও দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য প্রস্তত থাকতেন। লোকেরা যখন তাদের দুঃখ-কষ্টের গল্প বলত, তাদের হৃদয় অস্থির হয়ে উঠত। যেভাবে পারেন, সবার হৃদয়কে তিনি শান্তির সন্ধান দিতেন, উপাদান জোগাতেন। শত্রুরা গালমন্দ করত; কিন্তু তাদের মন একে পাত্তা দিতো না। তারা বিশ্বাস করতেন, মন্দের প্রতিদান যদি মন্দ দিয়ে দেওয়া হয়, তবে এই দুনিয়ায় মানব জীবন সর্বনাশের হাতে সমর্পিত হবে।
প্রকৃত তাসাউফ একমুখী, তার শেষ গন্তব্য মহাসমুদ্র; খোদার সন্তোষ ও সান্নিধ্য। কিন্তু তার পথ বিচিত্র। হাজারো নদীস্রোতে সে চলে। সকল নদীতে প্রবাহিত পানির নাম তাওহিদ। প্রধান স্রোতোধারার নাম খোদাপ্রেম ও সৃষ্টিসেবা। সত্যিকার আব্দিয়ত তথা খোদার দাসত্ব নদীর চলমানতা নিশ্চিত করে। এই আব্দিয়তকে জীবন্ত করতে সুফি কত বাক, কত ভাঙন, কত চর আর জোয়ার- ভাটার মধ্য দিয়ে যান, তার কোনো ইয়াত্তা নেই। তার যাপনে যে হালতই আসুক, কম্পাসের কাটার মতো তার সত্তা মগ্ন-মনোযোগী থাকে আল্লাহর দিকে। জীবনের সকল প্রয়োজন ও আয়োজনের ভেতরেও তিনি আল্লাহর মারিফতের মধ্যে নিমজ্জিত থাকেন, যেভাবে আমাদের বেঁচে থাকা নিমজ্জিত থাকে হাওয়ার ভেতর।